Self-link: go.kmonsoor.com/analysis-paralysis-bn

ছোটবেলায় মা খালাদের দেখতাম গাউসিয়া মার্কেটে একবার না গেলে রোজার ঈদের শপিং পরিপূর্ণ হতো না। সাথে গেলে দিন শেষে, ৩/৪ ঘণ্টা মার্কেটে প্রচণ্ড ঘুরাঘুরির পরে একটা কোন আইসক্রিম (বাজারে তখন নতুন) জুটতো :)

কিন্তু প্রচণ্ড বিরক্ত লাগত একটা জামা আর দুইটা উরনা কিনতে কেনো বিশটা দোকান ঘোরা লাগবে? এক দোকানে হাজারটা ডিজাইনের জামার ভিতরে একটাও কিভাবে পছন্দ না হয়?

রোগের নাম, অ্যানালাইসিস প্যরালাইসিস (Analysis paralysis)।


শুধু আমার মা খালা না, জাতি, ধর্ম, বয়স, লিঙ্গ ভেদে বেশির ভাগ মানুষই এই “রোগে” আক্রান্ত। আর এই রোগের প্রভাব শুধু আমাদের ব্যক্তি জীবন না, দাম্পত্য, সন্তান-লালন, চাকরি, ব্যবসা, ধর্ম-কর্ম সবকিছুতেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

ধরেন, আপনি স্ট্রবেরি ফ্লেভারের আইসক্রিম পছন্দ করেন, তো সাধারণ দোকানে গিয়ে চাইলে ওদের কাছে থাকা দুইটা দামের আছে, আপনি অনেকদিন পরে আইসক্রিম খাচ্ছেন, বেশি দামেরটাই নিলেন। দুই মিনিটে কাজ শেষ।

এবার ধরেন, আপনি এমন একটা আইসক্রিমের দোকানে গেলেন, সেখানে হাজারো আইসক্রিমের ফ্লেভার। পনেরো ধরণের স্ট্রবেরি ফ্লেভারের আইসক্রিম, প্রতি ফ্লেভারের আবার কাঠি, কাপ আর কোন তিন ধরণের আছে, তিন দামের। এখন আপনি চিন্তায় পরে গেলেন, সেরা কোনটা হবে, কোনটা খেলে নতুন একটা স্বাদও পাওয়া যাবে, আবার খুব ভালোও লাগবে। ইন্টারনেটে খুঁজলেন “best strawberry flavor”, দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলেন, সে তার নিজের মতামত দিলো, বা সবচেয়ে দামিটার কথা বললো। আপনি দোকানে দাঁড়িয়ে (বা বসে) পনেরো মিনিট ধরে ভাবছেন। এটাই এনালাইসিস প্যরালাইসিস। তারপরে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে, নিজের উপরে বিরক্ত হয়ে, হুট-হাট একটা কিনে নিয়ে বের হয়ে গেলেন।

অ্যানালাইসিস প্যরালাইসিস (Analysis paralysis)।


নারী, পুরুষ সবাই এই অসুখে ভোগেন। জামাকাপড় কিনতে, ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে, আধুনিক উপায়ে “ভালবাসার মানুষ” খুঁজতে … “ঈশ যদি এই খুঁতটা না থাকতো, সেরম হতো”, “আচ্ছা, আরেকটু দেখি”, “যদি বেস্টটা মিস হয়ে যায়?” আমার অভিজ্ঞতায় দেখা যে এই অসুখে ভুক্তভোগীরা সবশেষে যেটা বাছাই করে, সেটা ভদ্র ভাষায় বললে “না একূলের, না ওকূলের”। অথচ, এর আগে তার হাতে অনেক দিক দিয়ে ভালো অনেক অপশন এসেছিলো।

এদের শেষ সম্বল দাঁড়ায় “তকদিরে ছিলো”, “কপালে লেখা থাকলে কি করবো”, “দোকানদাররা এতো বাটপার”, “দেশ নষ্ট হয়ে গেছে”, ইত্যাদি।

যাই হোক, এই রোগ থেকে বের হয়ে আসার উপায় কি?


সবার আগে, একটা বিষয় মাথায় রাখা জরুরি। যে রোগ ত্রিশ বছর ধরে আপনার ভেতরে বড় হয়েছে, সেটা আপনি দুই দিনে সারিয়ে তুলতে পারবেন না; একটা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। ধীরে ধীরে অভ্যাস পালটাতে পারবেন।

আমি প্রক্রিয়ার ধাপ গুলা বুঝানোর জন্য একটা উদাহরণ ব্যবহার করবো। - আপনার ৬ বছর বয়সী মেয়ে সন্তানের জন্য ঈদের জামা কেনা লাগবে একটা।

  1. নতুন কিছু কেনা বা সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে (যেমন: পাত্রী দেখা), বাজেট নির্দিষ্ট করুন। টাকা এবং সময়ের।
    যেমন: আমি এই মার্কেটে ঢুকে এক ঘণ্টার ভিতরে এক হাজার টাকার ভিতরে জামা কিনে বের হয়ে যাবো।

  2. খোঁজ শুরুর আগেই, মনে মনে কিছু দিক (criteria) নির্দিষ্ট করে রাখেন। বা, কোথাও লিখে রাখেন।
    জামা হাল্কা নীল রঙের, কিছুটা পুঁতির কাজ ইত্যাদি।

  3. এবার এমন জায়গাতে খোঁজেন যেখানে আপনি জানেন, আপনার সমস্যার সমাধান বা যা কিনতে চাচ্ছেন, তা পাওয়া যাবার সম্ভাবনা খুব বেশি।
    যেমন, এদিক ওদিক দোকানে না ঢুকে, বাহির থেকে বেশিরভাগ বাচ্চাদের জামা কাপড় দেখা যাচ্ছে, মোটামুটি ভালো মানের এরকম একটা দোকানে ঢুকে দোকানদারকে বলেন, আপনার কাছে ৬-৭ বছরের বয়সী মেয়েদের হাল্কা নীল রঙের কি কি জামা আছে দেখান। পুঁতির কাজের কথাটাও বলতে পারেন। আশেপাশে যত গুলা জামা কাপড় ঝুলানো, দেখার দরকার নাই, যদি না ওখানে নীল কোন জামা থাকে।

  4. যদি সেই জায়গাতে প্রথমে খুঁজলেন, সেখানেই বেশ কিছু অপশন পাওয়া যায়, সেগুলা বিবেচনা করেন।
    জামার ক্ষেত্রে, আপনার মোটামুটি পছন্দ হয়েছে, এরকম তিনটা জামার দাম জিজ্ঞেস করেন। আপনার বাজেট দোকানদারকে বলার দরকার নাই, আপনার সবচেয়ে পছন্দের দুইটা দামাদামি আট, নয়শ টাকায় নিয়ে আসেন, না দিলে ফাইনালি ১০০০ টাকা বলে বের হয়ে আসেন। আর ফিক্সড প্রাইসের দোকান হোলে এই ধাপ পুরাপুরি বাদ দিতে পারেন।

  5. যদি প্রথম জায়গাতে না মিলে, আরেকটা জায়গাতে দেখেন, যেটা সম্ভাবনার দিক দিয়ে দ্বিতীয়।
    জামার ক্ষেত্রে, এরকম আরেক বা দুইটা দোকানে দেখেন। তিন দোকানেও যদি আপনার বাজেট অনুযায়ী না মিলে, ১ম বা ২য় ধাপে ফিরে যান। হয়তো, মার্কেটের তুলনায় আপনার বাজেট অনেক কম, অথবা এইটা ভুল মার্কেট।

  6. পৃথিবীতে কেউ বা কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি মুক্ত না। আপনি যত টাকা আর সময় খরচ করেই কোন কিছু পেতে চান না কেন, আজ না হয় কাল, আপনি এর ভিতরে ত্রুটি খুঁজে পাবেনই।


Perfection is an illusion. Look for “good enough” for the purpose.
এজন্য মনের সন্তুষ্টি আপনার কাছে; সব সময়ই আপনার থেকে ভালো জিনিস অন্যের কাছে থাকবে। আপনি যদি সবসময়ই নিজেরটা অন্যের সাথে তুলনা করেন, আপনার এই অভাব কেউ কোনকিছু দিয়েই পূরণ করতে পারবে না।

ইসলামের পরিভাষায়, তাকদিরে বিশ্বাস (অর্থাৎ, যা পেয়েছেন, তা আল্লাহ্‌ তাআলার পক্ষ থেকে) ঈমানের একটা স্তম্ভ। এজন্যে “যার অন্তর অভাবমুক্ত হয়ে যায়, তার দুই হাতও অভাবমুক্ত হয়ে যায়। আর যার অন্তর দরিদ্র হয়ে যায়, তার ধনাঢ্যতা তাকে কোন উপকার করতে পারে না।”

হিন্দু ধর্মে “আশুতোষ” নামটিও এসেছে “অল্পে তুষ্টি” থেকে।

মার্ক টোয়াইনের ভাষায় “Comparison is the death of joy.”

তো এই গুন যদি আপনি একবার অর্জন করতে পারেন, আপনার ৬ বছরের মেয়ে আপনার কাছে নয়শ টাকার নীল জামাতেই পরীর মতো সুন্দর লাগবে; আপনার ভালবাসার আলোতে ।
আর না থাকলে, আপনি মেয়ের জন্য কলকাতা থেকে আনা ষাট হাজার টাকার লেহাঙ্গাতেও সেই সন্তুষ্টি পাবেন না। ❤